বাংলাদেশ গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউট কর্তৃক উদ্ভাবিত বিডাব্লিউএমআরআই গম ৪ একটি আগাম এবং উচ্চ ফলনশীল গমের জাত। বারি গম ২১((Shatabdi)) এবং নেপালী লাইন BL 3503 এর মধ্যে বাংলাদেশে সংকরায়ন করে জাতটি উদ্ভাবন করা হয়েছে। বিভিন্ন প্রজন্মে ও আবহাওয়ায় পরীক্ষা নিরীক্ষা করে এ সারিটি বিএডাব্লিউ ১২৯০ নামে নির্বাচন করা হয়। বিভিন্ন নার্সারী ও ফলন পরীক্ষায় এ কৌলিক সারিটি অন্যান্য চেক জাতের তুলনায় ভাল করায় নির্বাচন করা হয়। প্রস্তাবিত জাতটি ২০১৯ ও ২০২০ সালের গবেষণা মাঠ পরীক্ষায় এবং ২০২১ সালে কৃষকের মাঠে উচ্চ ফলনশীল, লবণাক্ততা ও তাপসহিষ্ণু জাত হিসেবে প্রমানিত হয়েছে।
জাতের বৈশিষ্ট্য:
ফলন ৪.৫-৫.৫ টন/হে.
সনাক্তকারী বৈশিষ্ট: চারা অবস্থায় কুশিগুলো কিছুটা হেলানো থাকে। গাছের রং গাঢ় সবুজ। নিশান পাতা ছোট, চওড়া ও হেলানো। নিশান পাতার খোলে মাঝারি ধরণের মোমের মত আবরন থাকে। কান্ডের দেয়াল মোটা। শীষ ক্লাব আকৃতির। স্পাইকলেটে নিচের গ্লুমের ঘাড় মাঝারী চওড়া ও হালকাভাবে খাঁজ কাটা ঠোঁট ছোট এবং ঠোঁটে অনেক কাঁটা থাকে।
বপনের সময়: জাতটি বপনের উপযুক্ত সময় নভেম্বর মাসের ১৫ থেকে ৩০ পর্যন্ত (অগ্রহায়ণ মাসের ১ম থেকে ২য় সপ্তাহ পর্যন্ত। তবে জাতটি আগাম ও তাপসহনশীল হওয়ায় ডিসেম্বর মাসের ১৫-২০ তারিখ পর্যন্ত বুনলেও ভাল ফলন দেয়।
বীজের পরিমান: গজানোর ক্ষমতা শতকরা ৮০ ভাগ ও তার বেশি হলে হেক্টর প্রতি ১২০ কেজি বীজ ব্যবহার করতে হবে।
বীজ শোধন: প্রোভেক্স-২০০ নামক ছত্রাকনাশক (প্রতি কেজি বীজে ৩ গ্রাম হারে) মিশিয়ে বীজ শোধন করতে হবে। বীজ শোধন করলে বীজ বাহিত রোগ দমন হয় এবং বীজ গজানোর ক্ষমতা বৃদ্ধিসহ চারা সবল ও সতেজ হয় । বীজ শোধন করলে ফলন শতকরা ১০-১২ ভাগ বৃদ্ধি পাবে।
বপন পদ্ধতি: সারিতে অথবা ছিটিয়ে গম বীজ বপন করা যায়। সারিতে বপনের জন্য জমি তৈরীর পর ছোট লাঙ্গল বা বীজ বপন যন্ত্রের সাহায্যে ২০ সেমি বা ৮ ইঞ্চি দুরে দুরে সারিতে এবং ৪-৫ সেমি গভীরে বীজ বুনতে হবে। ধান কাটার পর পরই পাওয়ার টিলার চালিত বীজ বপন যন্ত্রের সাহায্যে স্বল্পতম সময়ে গম বোনা যায়। এ যন্ত্রের সাহায্যে একসঙ্গে জমি চাষ, সারিতে বীজ বপন ও মইয়ের কাজ করা যাবে।
সার প্রয়োগ:জমি চাষের শুরুতে হেক্টরপ্রতি ৫-১০ টন গোবর/কম্পোষ্ট জৈব সার হিসেবে ব্যবহার করা উত্তম। শেষ চাষের পূর্বে জমিতে হেক্টরপ্রতি ১৫০-১৭৫ কেজি ইউরিয়া, ১৩৫-১৫০ কেজি টিএসপি, ১০০-১১০ কেজি পটাশ ও ১১০-১২৫ কেজি জিপসাম সার সমান ভাবে ছিটিয়ে চাষ ও মই দিয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে।
সেচসহ চাষের ক্ষেত্রে চারার তিন পাতা বয়সে প্রথম সেচের পর দুপুর বেলা মাটি ভেজা থাকা অবস্থায় প্রতি হেক্টেের ৭৫-৯০ কেজি ইউরিয়া উপরিপ্রয়োগ করতে হবে। জমিতে প্রায়শঃ বোরন সারের ঘাটতি দেখা যায় বলে প্রতি হেক্টরে ৬.৫ কেজি হারে বরিক এসিড শেষ চাষের সময় অন্যান্য রাসায়নিক সারের সাথে প্রয়োগ করতে হবে। যে সব জমিতে দস্তা সারের ঘাটতি রয়েছে এবং পূর্ববর্তী ফসলে দস্তা প্রয়োগ করা হয়নি সে সব জমিতে শেষ চাষের সময় হেক্টরপ্রতি ১২.৫ কেজি দস্তা সার যথা জিংক সালফেট (মনোহাইড্রেট: শতকরা ৩৬ ভাগ জিংক সম্বলিত) শেষ চাষের সময় অন্যান্য রাসায়নিক সারের সাথে প্রয়োগ করা ভাল।
জমিতে অম্লীয় মাত্রা ৫.৫ এর নিচে হলে হেক্টরপ্রতি ১০০০ কেজি হারে ডলোচুন গম বপনের কমপক্ষে দু’সপ্তাহ আগে প্রয়োগ করতে হবে। প্রতি ৩ বছরে একবার ডলোচুন প্রয়োগ করতে হবে।
সেচ প্রয়োগ: মাটির প্রকার ভেদে গম আবাদে ২-৩টি সেচের প্রয়োজন হয়। প্রথম সেচ চারার তিন পাতার সময় (বপনের ১৭-২১ দিন পর) দ্বিতীয় সেচ শীষ বের হওয়ার সময (বপনের ৫০-৫৫ দিন পর) এবং তৃতীয় সেচ দানা গঠনের সময় (বপনের ৭৫-৮০ দিন পর) দিতে হবে। তবে মাটির প্রকারভেদে ও শুষ্ক আবহাওয়ায় ভাল ফলনের জন্য অতিরিক্ত এক বা একাধিক সেচ দেয়া ভাল। প্রথম সেচটি খুবই হালকা ভাবে দিতে হবে। তা না হলে অতিরিক্ত পানিতে চারার পাতা হলুদ যায় এবং চারা সম্পুর্ন বা আংশিক নষ্ট হয়ে যেতে পারে। সেচের পর পরই জমি থেকে অতিরিক্ত পানি বের করে দিতে হবে। তাই বপনের পর জমির ঢাল বুঝে ২০-২৫ ফুট অস্তর অন্তর নালা কেটে রাখতে হবে।
অন্যান্য পরিচর্যা: বীজ বপনের পর ১০-১২ দিন পর্যন্ত পাখি তাড়ানোর ব্যবস্থা রাখতে হবে যাতে বীজ বা চারার সংখ্যা সঠিক থাকে। বপনের ২৫-৩০ দিনের মধ্যে জমিতে ’জো’ অবস্থায় আগাছা দমনের জন্য নিড়ানী দিতে হবে। চওড়া পাতা জাতীয় আগাছা (বথুয়া ও কাকরি) দমনের জন্য এফিনিটি জাতীয় আগাছা নাশক প্রতি ১০ লিটার পানিতে ২৫ গ্রাম হিসেবে ভাল ভাবে মিশিয়ে ¯েপ্র মেশিনের সাহায্যে মেঘমুক্ত দিনে ৫ শতাংশ জমিতে একবার প্রয়োগ করতে হবে অথবা হ্যামার জাতীয় আগাছা নাশক প্রতি ১৫ লিটার পানিতে ৫মিলি ভাল ভাবে মিশিয়ে মেঘমুক্ত দিনে ১২ শতাংশ জমিতে একবার প্রয়োগ করতে হবে । সময় মত আগাছা দমন করলে ফলন শতকরা ১৫ ভাগ বৃদ্ধি পায়। ক্ষেতে ইঁদুরের আক্রমন শুরু হলে ফাঁদ পেতে বা বিষটোপ (জিঙ্ক ফসফাইড বা ল্যানিরেট) দিয়ে দমন করতে হবে।
গমের ব্লাস্ট ও অন্যান্য রোগ দমনের জন্য প্রতিরোধক ব্যবস্থা হিসেবে শীষ বের হওয়ার সময় একবার এবং তার ১২-১৫ দিন পর আরেকবার ফলিকুর, নাটিভো ৭৫ ডব্লিউ জি, ইত্যাদি ছত্রাকনাশক অনুমোদিত মাত্রায় পানিতে মিশিয়ে ভালভাবে স্প্রে করতে হবে।
ফসল সংগ্রহ: গম গাছ সম্পূর্নরূপে পেকে হলুদ বর্ণ ধারণ করলে কাটার উপযুক্ত সময় হিসেবে গন্য হবে। গম পাকার পর বেশি দিন ক্ষেতে থাকলে ঝড়/শিলা বৃষ্টিতে যথেষ্ট ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে সকালের দিকে গম কেটে দুপুরে মাড়াই করা উত্তম। মাড়াই যন্ত্রের সাহায্যে সহজে গম মাড়াই করা যায়।
বীজ সংগ্রহ ও সংরক্ষণ: বীজের বিশুদ্ধতা নিশ্চিত করণের জন্য শীষ বের হওয়ার পর হতে পাকা পর্যন্ত কয়েকবার অন্য জাতের মিশ্রণ, রোগাক্রান্ত গাছ এবং আগাছা গোড়াসহ উঠিয়ে ফেলতে হবে। বীজ সংগ্রহের জন্য গম পাকার পর হলুদ হওয়া মাত্রই কেটে রৌদ্রে শুকিয়ে আলাদা করে মাড়াই করতে হবে এবং মাড়াইয়ের পর কয়েক দিন বীজ শুকানোর ব্যবস্থা নিতে হবে। সংরক্ষণের ক্ষেত্রে বীজের আর্দ্রতা শতকরা ১২ ভাগ বা তার নিচে রাখতে হবে। দানা দাঁতের নিচে চাপ দিলে কট করে শব্দ হলে বুঝতে হবে যে, উক্ত বীজ সংরক্ষণের জন্য উপযুক্ত। সংরক্ষণের পূর্বে পুষ্ট বীজ চালনি দিয়ে চেলে বাছাই করে নিতে হবে।
প্লাস্টিক ড্রাম, ড্রাম, চটের বস্তার মধ্যে পলিথিন ব্যাগে বীজ সংরক্ষণ করা যায়। লক্ষ্য রাখতে হবে বীজ সংরক্ষণের পাত্র যেন ছিদ্রমুক্ত হয়। বীজ ভর্তির পর পাত্রের ভিতরে যেন কোন ফাঁকা জায়গা না থাকে। পাত্র সম্পূর্নভাবে বীজ ভর্তির পর শক্ত করে মুখ বন্ধ করে দিতে হবে যাতে বাইরের বাতাস ভিতরে প্রবেশ করতে না পারে। পলিথিন বা প্লাস্টিক জাতীয় পাত্রে সংরক্ষণের জন্য শুকানো বীজ ১০-১২ ঘন্টা ছায়ায় ঠান্ডা করে সংরক্ষণ করতে হবে। বীজ সংরক্ষিত পাত্র সরাসরি মেঝেতে না রেখে মাচার উপরে এবং ঘরের দেয়াল/বেড়া থেকে একটু দূরে রাখা উত্তম। গম বীজ সংরক্ষনের পূর্বে এবং বীজ বপনের এক সপ্তাহ আগে বীজ গজানোর হার (অংকুরোদগম) পরীক্ষা করা প্রয়োজন।